Sunday, April 20, 2025
Google search engine
HomeDesignগাজায় স্বপ্নভঙ্গের আর্তনাদ : বোমারু বিমানে ছিন্নভিন্ন ফটো সাংবাদিক ফাতেমা

গাজায় স্বপ্নভঙ্গের আর্তনাদ : বোমারু বিমানে ছিন্নভিন্ন ফটো সাংবাদিক ফাতেমা

গাজার তরুণ ফটো সাংবাদিক ফাতেমা হাসসুনা জানতেন, মৃত্যু সব সময় তাঁর দরজায় ওত পেতে থাকে। গত ১৮ মাস ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান হামলা, নিজের বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া, বিপুলসংখ্যক মানুষের বাস্তুচ্যুতি এবং পরিবারের ১১ জন সদস্যের মৃত্যু নিজ হাতে নথিভুক্ত করেছেন তিনি। এসব ঘটনা ক্যামেরাবন্দী করতে গিয়ে তাঁর একটাই চাওয়া ছিল—যেন নীরবে চলে যেতে না হয়!

‘যদি আমি মারা যাই, আমি একটি সরব মৃত্যু চাই’—সামাজিক মাধ্যমে লিখেছিলেন ফাতেমা। তিনি লেখেন, ‘আমি শুধু ব্রেকিং নিউজ বা একটি দলের সংখ্যা হতে চাই না, আমি এমন মৃত্যু চাই, যা বিশ্ব শুনবে; এমন প্রভাব রাখবে, যা সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাবে না; এমন একটি কালজয়ী ছবি হবে, যা কখনো কেউ বিস্মৃত হবে না।’

গত বুধবার বিয়ের কয়েক দিন আগে, ২৫ বছর বয়সী ফাতেমা হাসসুনা উত্তর গাজায় নিজ বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন। তাঁর অন্তঃসত্ত্বা বোনসহ পরিবারের আরও দশজন সদস্যও নিহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, এটি হামাসের এক সদস্যকে লক্ষ্য করে সুনির্দিষ্ট হামলা ছিল।

মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা আগে ঘোষণা এসেছিল, ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় ফাতেমার জীবন নিয়ে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র কান চলচ্চিত্র উৎসবের সময় একটি ফরাসি স্বাধীন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হবে।

ইরানি পরিচালক সেপিদেহ ফার্সি নির্মাণ করেছেন এই চলচ্চিত্র। ‘পুট ইওর সোল অন ইওর হ্যান্ড অ্যান্ড ওয়াক’ নামের এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ফাতেমা ও ফার্সির মধ্যে ভিডিও কথোপকথনের মাধ্যমে গাজার দুর্দশা এবং ফিলিস্তিনিদের দৈনন্দিন জীবনের গল্প বলার ওপর ভিত্তি করে। ফার্সি বর্ণনা করেছেন, ফাতেমা হয়ে উঠেছিলেন ‘গাজায় আমার চোখ…তেজি এবং প্রাণবন্ত। আমি তার হাসি, তার কান্না, তার আশা এবং তার বিষণ্নতা ধারণ করেছি।’

নির্মাতা ফার্সি সংবাদমাধ্যম ডেডলাইনকে বলেন, ‘সে ছিল এক উজ্জ্বল জ্যোতি, এত প্রতিভাবান! যখন আপনি ছবিটি দেখবেন, তখন বুঝতে পারবেন…। আমি কয়েক ঘণ্টা আগে তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তাঁকে জানিয়েছিলাম যে ছবিটি কানে যাচ্ছে। তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম।’

যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ফাতেমার জীবন নিয়ে ভয়ে ছিলেন ফার্সি। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেকে বলেছিলাম, আমার তো তার জন্য ভয় পাওয়ার অধিকার নেই, যদি সে নিজেই ভীত না হয়! আমি তার শক্তি, তার অটল বিশ্বাসের ওপর ভরসা রেখেছিলাম।’

ফ্রান্সে নির্বাসিত ইরানি নির্মাতা ফার্সি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ফাতেমাকে সম্ভবত তাঁর বহুল প্রচারিত ফটোসাংবাদিকতার কাজ এবং সম্প্রতি প্রচারিত প্রামাণ্যচিত্রে অংশগ্রহণের জন্য লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক ইতিহাসে সাংবাদিকদের জন্য গাজা সবচেয়ে মারাত্মক সংঘাতের ক্ষেত্র, ২০২৩ সাল থেকে ১৭০ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। অনেকে বলেছেন, এই সংখ্যা ২০৬।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজায় বোমাবর্ষণ শুরু করে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত ৫১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের অর্ধেকেরও বেশি নারী ও শিশু। গত মার্চে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইসরায়েল আবারও জোরেশোরে বিমান হামলা শুরু করেছে। গতকাল শুক্রবারের হামলায় অন্তত ৩০ জন নিহত হয়েছে।

গাজার সহকর্মী সাংবাদিকেরা ইসরায়েলি বিমান হামলায় ফাতেমার মৃত্যুতে শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গাজায় আলজাজিরার প্রতিবেদক আনাস আল-শরীফ বলেন, ‘বোমাবর্ষণ ও বন্দুকযুদ্ধের মধ্যে ফাতেমা তাঁর লেন্সে গণহত্যা নথিভুক্ত করেছেন, তাঁর ছবিতে মানুষের কষ্ট ও চিৎকার ধারণ করেছেন।’

গাজাভিত্তিক আরেক সাংবাদিক মিকদাদ জামিল মানুষকে ‘ফাতেমার তোলা ছবি দেখতে, তাঁর কথা পড়তে—তাঁর ছবি ও লেন্সে গাজার জীবন, যুদ্ধের মধ্যে শিশুদের সংগ্রাম দেখতে’ আহ্বান জানিয়েছেন।

ফাতেমার মৃত্যুতে কান অ্যাসিড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল একটি বিবৃতি দিয়েছে। এই উৎসবেই আগামী মে মাসে ফার্সির প্রামাণ্যচিত্রটি প্রদর্শিত হবে। তারা বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা এমন একটি চলচ্চিত্র দেখেছি এবং প্রোগ্রাম আয়োজন করেছি, যেখানে এই তরুণীর জীবনশক্তি একটি অলৌকিক ঘটনার মতো মনে হয়েছে! এটি তাঁর হাসি, তাঁর দৃঢ়তার মতোই জাদুকরী। বোমা, শোক ও ক্ষুধার সাক্ষী হওয়া, গাজার ছবি তোলা, খাবার বিতরণ করা। আমরা তাঁর গল্প শুনেছি, তাঁকে জীবিত দেখে তাঁর প্রতিটি উপস্থিতিতে আনন্দিত হয়েছি, আমরা তাঁর জন্য ভয় পেয়েছি।’

গাজার ফিলিস্তিনি কবি হায়দার আল-গাজালি ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্টে বলেছেন, নিহত হওয়ার আগে ফাতেমা তাঁকে তাঁর মৃত্যুর পর একটি কবিতা লিখে দিতে বলেছিলেন।

পরকালে ফাতেমার উজ্জ্বল পুনরুত্থান নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবি হায়দার আল–গাজালি। কবিতাটির কয়েকটি পঙ্‌ক্তি এ রকম: ‘আজকের সূর্য পোড়াবে না। টবের গাছপালা এক বিনয়ী অতিথির জন্য নিজেদের সাজিয়ে নেবে। এত উজ্জ্বল হবে যে, মায়েরা তাড়াতাড়ি কাপড় শুকাতে পারবে, আর এত শীতল হবে যে শিশুরা সারা দিন খেলতে পারবে। আজকের সূর্য কাউকে পোড়াবে না।’

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments